নবম অধ্যায়: সময়ের জানালা
জামান সাহেব বাড়ি ফিরে এলেও তার মন শান্ত হচ্ছিল না। আজকের সকালে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো মাথার মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছিল। পুরনো মন্দিরের পাশে সেই ফিসফিসানি, কুয়াশার মধ্যে দেখা কালো ছায়া, আর মকবুল চাচার কথা—সবকিছু যেন তাকে কিছু একটা বোঝানোর চেষ্টা করছিল।
রাতে ঘুম আসছিল না। বারান্দায় বসে আকাশের দিকে তাকিয়ে রইলেন। হঠাৎই মনে হলো, সময় থমকে গেছে। আশেপাশের সবকিছু স্থির হয়ে আছে। বাতাস বইছে না, কোনো পাখির ডাক নেই, এমনকি ঘরের ভেতর দেয়াল ঘড়ির কাঁটাটাও নড়ছে না।
তিনি চেয়ারে বসে থাকতে থাকতে চোখ একটু বুজেছিলেন।
তারপরই ঘটে গেল অবিশ্বাস্য কিছু।
একটা ঝলসানো আলো চারপাশে ছড়িয়ে পড়ল, মনে হলো তিনি যেন হালকা হয়ে যাচ্ছেন! শরীরটা মাধ্যাকর্ষণহীন অবস্থায় কোথাও টেনে নিয়ে যাচ্ছে! চারপাশে ঝলকানি, মাথা ঘুরে উঠল।
যখন চোখ খুললেন, তিনি সম্পূর্ণ ভিন্ন জগতে ছিলেন।
একটা পরিচিত কিন্তু অন্যরকম পরিবেশ। এ যেন সেই গ্রাম, কিন্তু এখানে সবকিছুই একটু বেশি উজ্জ্বল, একটু বেশি নিখুঁত। মানুষরা হেঁটে যাচ্ছে, তাদের চেহারায় এক অদ্ভুত প্রশান্তি। কিন্তু জামান সাহেব অনুভব করলেন, তাদের মুখে কোনো হাসি নেই।
তিনি এগিয়ে যেতে থাকলেন। একসময় গ্রামের বাজারের দিকে গেলেন, যেখানে সাধারণত ব্যস্ততা থাকে। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয়, এখানে সবাই যেন একটি অদৃশ্য নিয়ম মেনে চলছে, কারও মুখে কোনো আনন্দ নেই।
হঠাৎই তিনি দেখতে পেলেন, দূর থেকে একজন এগিয়ে আসছে।
আরও বিস্ময় অপেক্ষা করছিল!
এটা তিনিই!
তারই মতো দেখতে আরেকজন মানুষ! জামান সাহেব হতবাক হয়ে গেলেন।
“আপনি… আপনি কে?”
সামনের মানুষটি গভীরভাবে তাকালেন। “আমি জামান। তবে অন্য এক বাস্তবতা থেকে। তুমি যে জগতে ছিলে, সেটা শুধু একটা সম্ভাবনা। আর এই বাস্তবতায় সব মানুষ কর্মমুখী, এখানে স্বপ্ন বা অনুভূতি নেই।”
জামান সাহেব কেঁপে উঠলেন। “এটা কীভাবে সম্ভব?”
অন্য জামান শান্তভাবে বললেন, “বহু বিশ্ব বা মাল্টিভার্স বলে একটা জিনিস আছে। প্রতিটি সিদ্ধান্তই নতুন এক বাস্তবতা তৈরি করে। তোমার জীবন একটা চাকরি আর দায়িত্বে আটকে গিয়েছিল। কিন্তু একটা সময়, তুমি নিজেই তোমার জীবন থেকে পালানোর চেষ্টা করেছিলে। সেই চিন্তাগুলোই তোমাকে এখানে এনেছে।”
“তাহলে আমি কি আমার জগতে ফিরতে পারব?”
“হয়তো পারবে, তবে একটা শর্ত আছে।”
“কী শর্ত?”
অন্য জামান বললেন, “তোমাকে ঠিক করতে হবে—তুমি কোন জীবনটা বেছে নেবে? যেখানে তুমি দায়িত্বের বোঝায় আটকে, নাকি যেখানে তুমি সত্যিকার অর্থে জীবনকে উপভোগ করো?”
জামান সাহেব থমকে গেলেন। এতদিন ধরে তিনি শুধুই চাকরি, দায়িত্ব, আর পরিবারের চিন্তায় ডুবে ছিলেন। কখনো কি তিনি নিজের জন্য সময় বের করেছিলেন?
ঠিক তখনই চারপাশ আবার ঝলসে উঠল।
একটা প্রবল টান অনুভব করলেন। শরীরটা আবারও হালকা হয়ে গেল, যেন তিনি অন্য কোথাও ভেসে যাচ্ছেন।
“আমি কি আমার পৃথিবীতে ফিরে যেতে পারবো?”
তার চারপাশ অন্ধকার হয়ে গেল।
শেষ অধ্যায়ে কী ঘটবে?
জামান সাহেব কি তার জগতে ফিরতে পারবেন, নাকি তিনি হারিয়ে যাবেন সময়ের অসীম চক্রে?








