অধ্যায় ৭: অদ্ভুত রাত
রাত গভীর হচ্ছে। চারদিকে শুধু নিস্তব্ধতা, মাঝে মাঝে দু-একটা কুকুরের ডাক ভেসে আসছে। জামান সাহেব বারান্দায় বসে আছেন, তার সামনে টেবিলের ওপর একটা পুরনো ডায়েরি খোলা। বাতাসে আজ একটা অদ্ভুত ঠাণ্ডা ভাব, যেন কিছু একটা বদলে যাচ্ছে।
পুরনো ডায়েরিটা অনেকদিন পর তিনি বের করেছেন। কলেজ জীবনের সময়কার নোট, পুরনো চিঠি আর কিছু অজানা লেখা চোখে পড়ছে। এক জায়গায় লিখা—
“মানুষ ভাবে, তার হাতে সময় আছে। কিন্তু সময় কারো জন্য অপেক্ষা করে না। একদিন সব ফুরিয়ে যাবে…”
জামান সাহেব গভীর চিন্তায় পড়ে গেলেন। কে লিখেছিল এই কথাগুলো? এটা কি তারই লেখা, নাকি অন্য কারো?
হঠাৎ বাতাসের একটা শীতল ঝাপটা এসে ডায়েরির পাতা উল্টে দিলো। পাতা ওল্টানোর শব্দ শুনে তিনি কেমন জানি অস্বস্তি বোধ করলেন। মনে হলো, কেউ যেন ধীরে ধীরে তার দিকে এগিয়ে আসছে।
পাশের ঘরে স্ত্রী ঘুমিয়ে আছেন, ছেলেও এখনো ঘুমায়নি। কিন্তু কেন জানি এই মুহূর্তে পুরো বাড়িটা শুনশান লাগছে।
তিনি উঠে দাঁড়ালেন, একটু হাঁটতে চাইলেন। উঠোন পেরিয়ে মূল গেটের সামনে এলেন। চারদিক অন্ধকার, শুধু দূরের লাইটপোস্টের আলো পড়ে এক রহস্যময় পরিবেশ তৈরি করেছে।
ঠিক তখনই, একটা পরিচিত গলা শুনতে পেলেন।
“জামান ভাই…”
কিন্তু আশেপাশে কেউ নেই!
গলার স্বরটা অদ্ভুত রকমের চেনা লাগছে, যেন অনেক বছর আগে শোনা।
তিনি চারদিকে তাকালেন, কিন্তু কাউকে দেখতে পেলেন না। বাতাসের মধ্যে একটা অদ্ভুত গন্ধ। মনে হলো, পুরনো কাঠের পোড়া গন্ধ, যেটা তিনি বহু বছর আগে গ্রামের বাড়িতে অনুভব করেছিলেন।
আবার সেই গলাটা এলো, এবার একটু জোরে, “জামান ভাই, আপনি কি আমাকে ভুলে গেছেন?”
জামান সাহেবের শরীর কাঁপতে লাগলো।
এটা কি তার কল্পনা, নাকি বাস্তব?
তিনি পেছনে তাকিয়ে দেখলেন, তার ছেলেবেলার পুরনো বন্ধু রাসেল দাঁড়িয়ে আছে!
কিন্তু সেটা সম্ভব নয়!
রাসেল তো বহু বছর আগে একটা দুর্ঘটনায় মারা গেছে!
২
জামান সাহেব আর্তনাদ করতে চাইলেন, কিন্তু মুখ থেকে কোনো শব্দ বের হলো না।
রাসেল স্থির দাঁড়িয়ে আছে, তার মুখে অদ্ভুত এক হাসি।
“তুমি কীভাবে এখানে?” জামান সাহেব ফিসফিস করে জিজ্ঞাসা করলেন।
রাসেল কোনো উত্তর দিলো না, শুধু বলল, “ভুলে গেছ, তাই না? আমাদের শেষ বিকেলের সেই দিনের কথা?”
এই কথাটা শুনে জামান সাহেবের মাথার মধ্যে হঠাৎ এক ঝলক স্মৃতি ফিরে এলো।
সেই দিন বিকেলে তারা গ্রামের এক পুরনো পরিত্যক্ত বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে ছিল। রাসেল বলেছিল, “জামান, আমরা যদি আবার এখানে ফিরে আসতে না পারি, তাহলে কি কেউ আমাদের কথা মনে রাখবে?”
সেই কথা শুনে তিনি তখন হেসে বলেছিলেন, “পাগল নাকি? আমরা তো সবসময় থাকব!”
কিন্তু তারপর…
রাসেল হারিয়ে গিয়েছিল।
কেউ জানে না, কী ঘটেছিল সেদিন।
গ্রামের সবাই বলত, সে হয়তো নদীর পাড়ে পড়ে গিয়ে ডুবে গেছে। কিন্তু তার মৃতদেহ কখনো পাওয়া যায়নি।
আর আজ?
আজ সে দাঁড়িয়ে আছে তার সামনে!
৩
জামান সাহেব পেছনে সরে গেলেন, শরীরটা যেন জমে গেছে।
রাসেল ধীরে ধীরে তার দিকে এগিয়ে এলো।
“জামান ভাই, তুমি এত বছর পর এসেছো, কিন্তু আমার কথা একবারও মনে পড়েনি? আমি এখনো এখানে আটকে আছি।”
“না… এটা সম্ভব নয়…” জামান সাহেব ফিসফিস করলেন।
রাসেল এবার একটু এগিয়ে এসে বলল, “তুমি কি জানো, আমি কীভাবে হারিয়ে গিয়েছিলাম?”
জামান সাহেব চোখ বন্ধ করে ফেললেন, যেন সব ভুলে যেতে চান।
কিন্তু রাসেলের কণ্ঠস্বর কানে ভেসে এলো—
“তুমি আমার কথা শুনবে না?”
৪
তখনই, হঠাৎ করে পেছন থেকে কেউ যেন তাকে ডাকল।
“বাবা?”
সে চমকে উঠে তাকালেন।
তার ছেলে!
কোনো রাসেল নেই, কেউ নেই!
তিনি একা দাঁড়িয়ে আছেন উঠোনে।
ছেলে উদ্বিগ্ন হয়ে বলল, “বাবা, তুমি এখানে কী করছ? শরীর খারাপ লাগছে নাকি?”
জামান সাহেব চারদিকে তাকালেন।
সব স্বাভাবিক। কোনো অদ্ভুত কণ্ঠস্বর নেই, রাসেল নেই, কেবল নরম বাতাস বইছে।
তাহলে কি তিনি স্বপ্ন দেখছিলেন?
নাকি এটা বাস্তব ছিল?
ছেলের দিকে তাকিয়ে তিনি দীর্ঘশ্বাস ফেললেন।
“না… কিছু না। চলো ভেতরে যাই।”
কিন্তু মনের মধ্যে একটা প্রশ্ন রয়ে গেল।
রাসেল কি সত্যি এসেছিল? নাকি এটা তার নিজের স্মৃতির ভ্রম ছিল?
আর যদি রাসেল সত্যি সত্যি ফিরে এসে থাকে… তবে সে কি আবার আসবে?
চলবে…
এই অধ্যায়ে এক ধরনের রহস্যময়তা যোগ করা হয়েছে। গল্পের পরবর্তী অধ্যায়ে এই রহস্য আরও গভীর হবে।








