আরিফ শেষবারের মতো নিজের শ্বাস নিলেন, যখন তিনি অন্ধকার গহ্বরের কিনারায় দাঁড়িয়ে ছিলেন। পেছনে সাদা কুয়াশায় ডুবে গেছে তার পরিচিত ঘর, বই, এবং সেই প্রাচীন ঘড়ি। চোখের সামনে এখন শুধুই এক অদ্ভুত আলো, যা কুয়াশার বুক চিরে ডেকে নিচ্ছে তাকে—যেন এই আলোই সময়ের চূড়ান্ত রহস্যের দ্বার।
একটা ক্ষীণ কণ্ঠ বারবার তার কানে বাজছে, “তুমি কি প্রস্তুত?”
কোনো উত্তর না দিয়ে তিনি গহ্বরের মধ্যে লাফ দিলেন।
অচেনা আলোর জগৎ
লাফ দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে অনুভব করলেন, যেন মুক্ত আকাশে ভেসে যাচ্ছেন। আশপাশে আর কোনো দেওয়াল বা মেঝে নেই—শুধু অনন্ত সাদা আলো। প্রথমে একটা মাথা ঘোরানো অনুভূতি হলো, তারপর ধীরে ধীরে যেন শরীর হালকা হয়ে আসতে লাগল।
হঠাৎই আশপাশের সাদা আলো ভেঙে গিয়ে তিনি দেখলেন, একটা সুবিশাল স্থানে এসে পড়েছেন। স্থানটি যেন একইসাথে পরিচিত ও অচেনা—নানা স্তরের পথ, অদ্ভুত সব দরজা, আর বিভিন্ন উচ্চতার টাওয়ার বা স্তম্ভ। বাতাসে এক ধরনের সঙ্গীতময় গুঞ্জন, যাকে ভাষায় বোঝানো কঠিন। মনে হলো, এটি সময়ের এক ভিন্ন মাত্রা, যেখানে অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ একাকার হয়ে আছে।
একটি দরজার সামনে তিনি থমকে দাঁড়ালেন—দরজাটি অনেক বড়, গায়ে সূক্ষ্ম নকশা। ওপরে লেখা, “সময়ঃ প্রবেশাধিকার শুধুমাত্র খোলা মনে।” আরিফ বুঝতে পারলেন, এই দরজাই সম্ভবত তার শেষ বাঁধা। তিনি ধীরে ধীরে দরজাটার নব ঘুরালেন।
সময়ের রাজ্য
দরজা খুলতেই চোখে পড়ল, চারদিকে নানান সময়ের টুকরো যেন বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছে—কোথাও আধুনিক নগরের দৃশ্য, কোথাও প্রাচীন সভ্যতার নিদর্শন, কোথাও আবার ভবিষ্যতের অদ্ভুত যন্ত্র। সবকিছু যেন একে অপরের ভেতর দিয়ে বয়ে যাচ্ছে।
কিছু দূর এগিয়ে তিনি দেখলেন, একটা স্বচ্ছ জলাধারের মতো কিছু, যার ওপর লেখা: “সময়-আয়না (Time Mirror)”। আরিফ সেখানে গিয়ে দাঁড়াতেই জলাধারের ওপর তার নিজের মুখ ভেসে উঠল—কিন্তু মুখটা দ্রুত পাল্টে যাচ্ছে! কখনো দেখাচ্ছে সে যুবক, কখনো বয়স্ক, কখনো আবার একেবারে শৈশবে ফিরে গেছে।
এই পরিবর্তন দেখে তার মনে হলো, “সময় আমাকে দেখাচ্ছে, আমি কত রকমের হতে পারি।” অতীত, বর্তমান, ভবিষ্যৎ—সবগুলো আমারই অংশ। তিনি বুঝলেন, এই আয়নাই দেখাচ্ছে যে সময় আসলে আমাদের জীবনের বহুরূপী প্রতিফলন।
অতীতের মুখোমুখি
হঠাৎ আয়নায় দেখা গেল, তার পুরনো স্মৃতিগুলো স্পষ্ট হয়ে উঠছে—ছেলেবেলায় গ্রামের বাড়িতে খেলা, বন্ধুর সাথে মনোমালিন্য, প্রিয়জনকে হারানোর বেদনা। প্রতিটি স্মৃতি যেন ধাপে ধাপে ভেসে উঠছে। আরিফ বুঝতে পারলেন, এই স্মৃতিগুলোই তার অতীত, যা তাকে গড়ে তুলেছে।
এক মুহূর্তে, সেই বন্ধ ঘরের কথা মনে পড়ল—প্রথম অধ্যায়ের নিঃসঙ্গতা, জানালার বাইরে কিছুই দেখা না যাওয়া, সেই প্রাচীন ঘড়ির ধাতব শব্দ। তিনি অবচেতনে ভাবলেন, “আমি কি তখন থেকেই বন্দি ছিলাম? নাকি আমার নিজের মনের ঘরে আটকে ছিলাম?”
বর্তমানের উপলব্ধি
জলাধারের পানি আবার নড়ে উঠল। এবার ভেসে উঠল তার বর্তমান চেহারা—অস্থির চোখ, কপালে চিন্তার ভাঁজ, কিন্তু মুখে একটা কঠিন প্রত্যয়। এই মুহূর্তে, সে দাঁড়িয়ে আছে সময়ের রাজ্যে, যেখানে প্রতিটি পদক্ষেপ ভবিষ্যৎকে গড়ে দিচ্ছে।
সে নিজের হাত বাড়িয়ে জলাধারে স্পর্শ করল। একটা শীতল স্রোত তার হাতে বয়ে গেল, আর মনে হলো, তার সমস্ত সংশয়, দ্বিধা ধুয়ে যাচ্ছে। বর্তমান হলো এই মুহূর্ত, যখন সে সচেতনভাবে সময়ের সাথে সংযোগ খুঁজে পেয়েছে।
ভবিষ্যতের দিগন্ত
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে আরিফ সামনে এগিয়ে গেল। দেখল, সামনেই একটা বড় সেতু, যেটা অসীম অন্ধকারে মিলিয়ে গেছে। সেতুর ওপরে একটা ফলক, তাতে লেখা—“যদি তুমি অতীতকে মেনে নাও, বর্তমানকে গ্রহণ করো, তবেই ভবিষ্যতের পথে পা বাড়াতে পারবে।”
এই লাইন পড়ে সে থেমে গেল। এতদিন ধরে যে locked room-এ ছিল, যে অদ্ভুত ঘড়ি আর বইয়ের পাতায় নানা সংকেত দেখেছে—সবকিছুর মানে কি শেষ পর্যন্ত এটুকুই? যে সময়কে পুরোপুরি গ্রহণ করতে হবে, তা না হলে আমরা জীবনের বৃত্তে বন্দি থাকি?
সেতুতে পা দেওয়ার সাথে সাথে একটা আলো ফুটে উঠল, আর দূর থেকে দেখা গেল, সেতুর অপর প্রান্তে একটা অতিকায় ঘড়ির টাওয়ার, যার কাঁটাগুলো বিশাল। মনে হলো, এই ঘড়ি সেই মহাজাগতিক সময়কে নির্দেশ করছে, যা পৃথিবীর দৈনন্দিন ঘড়ির সীমানার বাইরে।
সময়ের শেষ ধাঁধা
আরিফ সেতুটা পেরিয়ে ঘড়ির টাওয়ারের সামনে গিয়ে দাঁড়াল। দরজার ওপর বড় হরফে লেখা—“ঘড়ির কাটা: শেষ ধাঁধা”। এক অদ্ভুত কম্পন তার সারা দেহে ছড়িয়ে পড়ল।
টাওয়ারের ভেতর ঢুকতেই সে দেখল অসংখ্য ঘড়ির কাঁটা ঘুরছে—কিছু সেকেন্ড, কিছু মিনিট, কিছু ঘণ্টা, আবার কিছু বছরের মাপকাঠিতে। কাঁটাগুলো সুনসান নীরবে ঘুরছে, কিন্তু মনে হচ্ছে এক অনন্ত সঙ্গীত বেজে চলছে।
টাওয়ারের কেন্দ্রে একটা স্বচ্ছ স্তম্ভ। তার ভেতর একটা স্ফটিকের মতো বস্তু, যা থেকে অদ্ভুত আলো বিচ্ছুরিত হচ্ছে। স্তম্ভের গায়ে খোদাই করা—
“সময় কোনো বাহ্যিক শক্তি নয়, বরং মানুষের অন্তর্দৃষ্টি। যদি তুমি নিজেকে বুঝতে পারো, সময় তোমার সামনে আত্মপ্রকাশ করবে।”
এক মুহূর্তে আরিফের মনে হলো, সময় আসলে আমাদেরই সৃষ্টি—আমরা অতীতকে স্মৃতি হিসেবে রাখি, বর্তমানকে অনুভব করি, আর ভবিষ্যৎকে স্বপ্ন হিসেবে কল্পনা করি। সময় তখনই গতি পায়, যখন আমরা তাকে মেনে নিই কিংবা প্রত্যাখ্যান করি।
মুক্তির পথ
টাওয়ারের মধ্যে হঠাৎ একটা প্রবল ঝলকানি হলো। চারপাশে আলো আর অন্ধকার মিলেমিশে একাকার। আরিফ চোখ বন্ধ করে ফেলল। যখন আবার চোখ খুলল, দেখল সে সেই ঘরের মেঝেতে শুয়ে আছে—প্রথম অধ্যায়ের সেই পরিচিত ঘর, দরজা-জানালা বন্ধ, টেবিলের ওপর ছড়ানো বই, আর কোণে সেই পুরনো ঘড়ি।
কিছুক্ষণ চুপ করে রইল, তারপর উঠে দাঁড়াল। দরজাটা ধাক্কা দিল। আশ্চর্য! এবার দরজাটা খুলে গেল। বাইরে একটা উজ্জ্বল সকাল। পাখির ডাকে বাতাস মুখরিত। তিনি অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলেন—এই তো সেই বাস্তব, যে বাস্তবকে তিনি এতদিন খুঁজে বেড়াচ্ছিলেন।
হঠাৎ ঘরের কোণ থেকে একটা ক্ষীণ টিকটিক শব্দ হলো। ঘড়িটার দিকে তাকালেন। এখন আর কোনো অদ্ভুত সময় বা সংকেত নেই; বরং ঘড়িটা স্বাভাবিকভাবে এগোচ্ছে—সকাল ৮টা বাজে। মনে হলো, এই ঘড়ি এখন মুক্ত, তিনিও মুক্ত।
তিনি বইয়ের পাতাগুলো একবার দেখে নিলেন—সব লেখা স্বাভাবিক, কোনো লাল কালি বা অদ্ভুত মানচিত্র নেই। তিনি বুঝলেন, এই সময়ের রহস্য মূলত তার নিজের মধ্যেই ছিল। তার মনই ছিল সেই লকড রুম, তার দ্বিধা আর সংশয়ই ছিল দরজা-জানালায় শিক। আর এখন, তিনি সেই দ্বিধা কাটিয়ে উঠেছেন।
শেষ ভাবনা
বাইরের পৃথিবীতে পা রেখে আরিফ ধীরে ধীরে হাঁটতে লাগলেন। সকালবেলার আলো তার চোখে-মুখে এসে লাগছে, মনে হচ্ছে যেন নতুন এক জন্ম হলো। তিনি জানেন, সময় এখন তার কাছে একটা যন্ত্রের কাঁটা বা একগুঁয়ে ধারা নয়; বরং একটি জীবনদর্শন, যেখানে প্রতিটি মুহূর্তে লুকিয়ে থাকে অতীতের শিক্ষা, বর্তমানের বাস্তবতা, আর ভবিষ্যতের সম্ভাবনা।
হয়তো কখনো আবার সেই ঘড়ি কোনো সংকেত দেবে, আবার কোনো বইয়ের পাতা অদ্ভুতভাবে খুলে যাবে, কিংবা কোনো দরজা মিডনাইট প্যাসেজের মতো ডেকে নেবে। কিন্তু এবার তিনি প্রস্তুত—তিনি জানেন, সময় আসলে মন আর বাস্তবতার এক অদ্ভুত খেলাঘর।
যে পাঠকরা এই যাত্রায় আরিফের সাথে ছিলেন, তাদের জন্য এই উপলব্ধি—আমাদের জীবনে কতটা সম্ভাবনা লুকিয়ে আছে, যদি আমরা সময়ের স্রোতে নিজেকে ভাসতে দিই আর সেই স্রোতকে ঠিকভাবে বুঝতে শিখি।
এটাই তার “ঘড়ির কাটা” গল্পের শেষ অধ্যায়, যেখানে সময়ের বন্দিদশা আর মনোজগতের দ্বন্দ্ব এক নতুন আলোর পথে এসে শেষ হলো—অথবা হয়তো একটা নতুন শুরু হলো!
(শেষ)








