ঘড়ির কাঁটা ১২:০১-এ এসে থেমে যেতেই চারপাশের আবহাওয়া পাল্টে গেল। বাতাস যেন ঘন হয়ে উঠল, আর ঘরের দেয়ালগুলো হালকা ঝাপসা হতে শুরু করল। আরিফ আতঙ্কে আর বিস্ময়ে একসাথে জমে গেল। এতক্ষণ যেটা ছিল একটি ছোট ঘর, সেটি এখন যেন অন্য কোনো বাস্তবতায় রূপ নিচ্ছে।
তিনি ধীরে ধীরে ঘড়িটার কাছে এগিয়ে গেলেন। হাত দিয়ে ধরতেই আবার সেই অদ্ভুত ঝাঁকুনি অনুভূত হলো, যেন ঘড়ির ভেতর থেকে একটা অদৃশ্য শক্তি তাকে টেনে নিচ্ছে। তিনি কাঁচের নিচে তাকিয়ে দেখলেন, আগের সেই লেখাগুলো আর নেই। বরং একটা অস্পষ্ট মানচিত্রের মতো কিছু ফুটে উঠেছে।
কাঁচের ওপর ভেসে থাকা মানচিত্রটা বেশ জটিল। তাতে কয়েকটা বিন্দু আর রেখা দেখা যাচ্ছে, কোথাও কোথাও আবার কিছু প্রতীক—যেন কোনও প্রাচীন ভাষায় লেখা। আরিফ চোখ কুঁচকে দেখার চেষ্টা করল। এক জায়গায় দেখতে পেল, একটা বড় ‘X’ চিহ্ন। ঠিক তার পাশেই খসখসে অক্ষরে লেখা আছে, “Midnight Passage”।
“মিডনাইট প্যাসেজ?” মনে মনে উচ্চারণ করল আরিফ। এটা কী?
অবস্থাটা যেন স্বপ্নের মতো লাগছে। ঘরের মেঝেতে ছোট ছোট কম্পন হচ্ছে, দেয়ালের রং ফিকে হয়ে যাচ্ছে, আর মাথার ভেতর একটা নিঃশব্দ গুঞ্জন শোনা যাচ্ছে।
হঠাৎই বইয়ের স্তূপের দিক থেকে একটা শব্দ হলো—মৃদু, কিন্তু স্পষ্ট। তিনি দ্রুত সেদিকে এগিয়ে গেলেন। দেখলেন, “সময় ও অস্তিত্ব” বইটা আপনাআপনি খুলে গেছে, আর তার ভেতর একটা পাতায় নতুন কিছু লেখা ফুটে উঠছে। আগের পাতাগুলোর মতো পুরনো কালি নয়, বরং একটা ঝলমলে নীল আলোয় লেখা—
“সময় কেবল ঘড়ির কাঁটায় ধরা দেয় না। সময় কখনো কখনো মানচিত্রের মতো। যেখানে তুমি চাইলে প্রবেশ করতে পার, চাইলে আবার বেরিয়ে আসতে পারো—যদি পথ চেনো।”
আরিফ বইটা হাতে তুলে নিল। পাতাটার উজ্জ্বল আলো দেখে চোখ কুঁচকে গেল। মনে হলো, মানচিত্রের এই নীল আভা আর ঘড়ির কাঁচে ভেসে থাকা অদ্ভুত নকশা—দুটো একই সূত্রে বাঁধা।
“আমাকে কি এই মানচিত্র ধরে কোথাও যেতে হবে?” নিজেকে প্রশ্ন করল আরিফ।
বইয়ের নিচে আরও কিছু লেখা—
“মধ্যরাতের পর পথ খুলে যায়, কিন্তু পথ চেনার জন্য মনকে মুক্ত করতে হবে। বাইরে যাওয়ার দরজা খোলা নেই, তবে সময়ের দরজা হয়তো খোলা থাকতে পারে।”
তার মনে পড়ল, ঘরের দরজা সে অনেকবার ধাক্কিয়ে দেখেছে, খুলছে না। জানালায় বাইরে কিছুই দেখা যায় না। কিন্তু বইটা বলছে, হয়তো অন্য এক ‘পথ’ আছে—যা ঘড়ির মাধ্যমে সময়কে ডিঙিয়ে যেতে সাহায্য করবে।
একটু পরই ঘড়িটার কাঁচে ভেসে থাকা মানচিত্রটা মৃদু আলো ছড়াতে লাগল। আরিফ দেখতে পেল, সেই ‘X’ চিহ্নের চারপাশে একটা গোল আলো নড়াচড়া করছে, যেন তাকে নির্দেশ দিচ্ছে—“এখানে যাও!”
তিনি বইটা টেবিলের ওপর রাখলেন, ঘড়িটা হাতে তুলে নিলেন। ঘরের মেঝে আর দেয়ালগুলো এখন প্রায় অদৃশ্য। আশপাশে কুয়াশার মতো সাদা ধোঁয়া ভেসে বেড়াচ্ছে। শুধু ঘড়ি আর বইগুলোর অর্ধেক দৃশ্যমান।
“একি! ঘরটা কি ভেঙে যাচ্ছে?”
পেছন থেকে হঠাৎ একটা ফিসফিসানি শোনা গেল, ঠিক আগের অধ্যায়ের মতো—“তুমি কি প্রস্তুত?”
আরিফের শরীর দিয়ে একটা শীতল স্রোত বয়ে গেল। তিনি ঘড়িটা শক্ত করে ধরলেন। “আমি কোথায় যাচ্ছি? এই ‘মিডনাইট প্যাসেজ’ আবার কী?”
কেউ উত্তর দিল না, কিন্তু ঘড়িটার কাঁটা এবার অদ্ভুত গতিতে ঘুরতে লাগল—১২:০১, ১২:০২, ১২:০৩… একে একে মিনিট পার হচ্ছে, আর সেই সাথে ঘরের সবকিছু সাদা কুয়াশার মধ্যে মিশে যাচ্ছে।
একসময় চারপাশে শুধু সাদা ধোঁয়া আর ঘড়ির নীল আভা দেখা গেল। বইগুলোর পাতাগুলো উড়ে উড়ে এসে তার পায়ের কাছে পড়ছে। পাতাগুলোর ওপর অদ্ভুত সব ভাষা আর প্রতীক। সবকিছু মিলেমিশে এক রহস্যময় আবহ তৈরি করেছে।
আরিফ ভাবল, “আমাকে কি এখনই এই মানচিত্র অনুযায়ী পথ খুঁজতে হবে?”
বইয়ের পাতা আর ঘড়ির আভা দেখে তিনি একটা কথা বুঝতে পারলেন—সময় ও বাস্তবতা এখানে মিলেমিশে গেছে, আর তাকে এর মাঝখান দিয়ে একটা পথ বের করতে হবে।
ঠিক তখনই, ঘড়ির কাঁটা ১২:০৫-এ পৌঁছতেই একটা গম্ভীর আওয়াজ হলো—ধপ করে যেন একটা দরজা খুলল। কোথা থেকে সেই দরজাটা এলো, বোঝা যাচ্ছে না। সাদা কুয়াশার ভেতর দিয়ে একটা অন্ধকার চৌকাঠ দেখা গেল।
ঘড়ির কাঁচে আবার সেই নীল আলো ফুটে উঠল—“Midnight Passage—Enter?”
আরিফ একবার ঘড়ির দিকে তাকাল, একবার বইগুলোর দিকে, তারপর ওই দরজার দিকে পা বাড়াল। কুয়াশার পর্দা ভেদ করে দরজাটার সামনে গিয়ে দাঁড়াতেই গা ছমছমে একটা অনুভূতি হলো।
সে জানে না, দরজার ওপাশে কী আছে। কিন্তু মনে হলো, অন্য কোনো উপায়ও নেই। এই ঘর, এই সময়, সবকিছুই ধোঁয়ায় পরিণত হচ্ছে।
একটি দীর্ঘশ্বাস ফেলে সে হাত বাড়িয়ে দরজাটার নব ধরে টান দিল।
(চলবে…)








