ঘরটা ছোট, কিন্তু বিশৃঙ্খল নয়। চারদিকে শুধু বই আর বই। একটা পুরনো কাঠের টেবিল, তার ওপরে রাখা কয়েকটা খুলে রাখা পাতা, একটা কলম, আর এক কোণে রাখা একমাত্র সঙ্গী—একটা প্রাচীন হাতঘড়ি। ঘড়িটা টিকটিক শব্দ করে চলেছে, কিন্তু তার চলার ধরণটা যেন কেমন অস্বাভাবিক।
আরিফ ধীরে ধীরে ঘরের ভেতর পায়চারি করছিল। না, ঘরের বাইরে যাওয়ার কোনো উপায় নেই। দরজাটা শক্ত করে বন্ধ, জানালাগুলো লোহার শিক দিয়ে আটকানো। কেবল একটাই জানালা আছে, যেটার কাঁচের ওপাশে কিছুই দেখা যায় না। যেন বাইরের পৃথিবী বলে কিছু নেই।
তিনি জানেন না, কত দিন, কত রাত এখানে কাটিয়েছেন। কেবল একটা জিনিসই বুঝতে পারছিলেন—সময় থেমে নেই, কিন্তু সময়ের কোনো হিসাব নেই। তার একমাত্র সঙ্গী এই ঘড়ির কাটা। অথচ এই ঘড়িটাও যেন কিছু একটা লুকিয়ে রেখেছে। তার মনে পড়ে, প্রথম দিন যখন ঘুম ভেঙে এই ঘরটায় নিজেকে আবিষ্কার করেছিলেন, ঘড়িটা তখন রাত ১২টায় আটকে ছিল। তিনি অনেক চেষ্টা করেও সেটার কাঁটা নড়াতে পারেননি। কিন্তু কিছুক্ষণ পর হঠাৎই সেটা চলতে শুরু করে।
তিনি নিজের মুখ ছুঁয়ে দেখলেন। খোঁচা খোঁচা দাড়ি, অবিন্যস্ত চুল। মনে পড়ছে না, শেষ কবে আয়নায় নিজেকে দেখেছিলেন। এই ঘরে কোনো আয়না নেই। বাইরের আলো ঢোকার কোনো উপায় নেই। কেবল একটা হলুদ আলো জ্বলছে, সেটাও মৃদু। যেন সময়ের সাথে সাথে তার শক্তি কমে আসছে।
হঠাৎ করে তিনি বইগুলোর দিকে তাকালেন। প্রতিটি বইয়ের মলাট পুরনো, কিন্তু তার নামের সাথে মিল নেই। কিছু বই তিনি পড়েছেন, কিছু বই তাকে অচেনা লাগছে। তিনি একটা বই তুলে নিলেন। নাম লেখা—“সময় ও অস্তিত্ব।” পাতা ওল্টাতে গিয়ে দেখলেন, কিছু পৃষ্ঠায় শব্দ নেই, কিছুতে শুধু সংকেতের মতো কিছু অক্ষর। যেন কোনো এক অজানা ভাষা।
তারপর আবার সেই টিকটিক শব্দ।
ঘড়ির কাটা থেমে গেছে।
তার শরীর হিম হয়ে গেল।
তিনি ধীরে ধীরে ঘড়িটার দিকে এগোলেন। কাঁপা কাঁপা হাতে সেটা তুলতে গিয়েও থেমে গেলেন। কারণ, এবার ঘড়ির কাঁচের নিচে একটা নতুন সংখ্যা জ্বলছে—“২৩:৫৯”। কিন্তু কিছুক্ষণ আগেও সেখানে কোনো ডিজিটাল সংখ্যা ছিল না। এই ঘড়িটা কি তার সাথে খেলা করছে? নাকি এটা একটা সংকেত?
তিনে ধীরে ধীরে টেবিলের সামনে বসলেন। তার চোখ ঘড়ির দিকে স্থির হয়ে আছে। একটা ভয় কাজ করছে, যেন ঘড়ির কাটা আবার চালু হলে কিছু একটা ঘটবে।
তারপরই হঠাৎ—
ঘড়ির কাটা এক সেকেন্ড এগিয়ে গেল।
তারপর পুরো ঘরটা কেঁপে উঠল।








